বৈদিক সভ্যতার সপ্ত ঋষির নামে আকাশে জ্বলজ্বল করে সপ্তর্ষিমণ্ডল | আকাশপাঠের পাশাপাশি আসুন একবার খোঁজার চেষ্টা করি সেই সাত ঋষিকে। হিন্দু পুরাণের নানা উৎসে সাত ঋষির নাম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে | তবে সবথেকে বেশি স্থানে যাঁদের নাম রয়েছে তাঁদের কথাই বলব | সেই সাত ঋষি হলেন ভৃগু‚ অত্রি‚ অঙ্গীরা‚ বশিষ্ঠ‚ পুলস্থ্য‚ পুলহ ও ক্রতু। এই পর্বে ভৃগুর কথা।
মহর্ষি ভৃগু ছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসপুত্র | ঋক বৈদিক যুগে তিনি মনুর সমসাময়িক | মনুর সন্তান হল মানব | ভৃগুর সন্তানদের বলা হয় ভার্গব |
বৈদিক জনপদ ব্রহ্মবর্তে দোশি পর্বতে বধূসার নদীর পাশে ছিল তাঁর আশ্রম | এখন এই অঞ্চল পরে রাজস্থান হরিয়ানা সীমান্তে | স্কন্ধ পুরাণ অনুযায়ী‚ ভৃগু পরে চলে যান ভৃগুকচ্ছে ( আজকের গুজরাতে‚ নর্মদা নদীর পাশে )‚ জায়গাটির নাম কালক্রমে হয়ে দাঁড়ায় ভারুচ |
ভৃগুর এক পত্নী হলেন দক্ষকন্যা খ্যাতি | তাঁদের দুই পুত্র হলেন ধাতা ও বিধাতা | কন্যার নাম ভার্গবী | যিনি আবার বিষ্ণুপত্নী | আর এক পত্নী কাব্যমাতার পুত্র হলেন শুক্র | যিনি আবার শুক্রাচার্য রূপে অসুরদের গুরু হন | ভৃগুর পত্নী পুলোমা জন্ম দেন ঋষি চ্যবনের | আবার ভৃগুর এক পুত্র হলেন জমদগ্নি | যিনি আবার পরশুরামের পিতা |
একবার পুণ্যতোয়া সরস্বতীর তীরে বসেছিল মহাযজ্ঞের আসর | সম্মিলিত ঋষিরা স্থির করে উঠতে পারলেন না ত্রিদেবের মধ্যে কে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ | নিরূপণের ভার পড়ল ভৃগুর উপর |
ভৃগু প্রথমে গেলেন ব্রহ্মলোকে | যথাবিহিত সম্মান না দেখিয়েই জানালেন আগনমহেতু | শুনে তো মহাপ্রজাপতি রেগে অগ্নিশর্মা | ভৃগু কিনা তাঁদের মহত্ব বিচার করবেন ! তাঁর ক্রোধানল থেকে ভৃগুকে বাঁচালেন স্ত্রী সরস্বতী |
কিন্তু ব্রহ্মার এই আচরণে ভৃগু ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন | তিনি অভিশাপ দিলেন‚ নরলোকে ব্রহ্মা পূজিত হবেন না | ভেবে দেখুন‚ রাজস্থানের পুষ্কর ছাড়া ব্রহ্মার মন্দির দুর্লভ |
এবার ভৃগু গেলেন কৈলাসে | কিন্তু মহাদেবের দেখা পেলেন না | কারণ তিনি তখন পার্বতীর সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত | রাগে ফুঁসতে থাকা ভৃগু অভিশাপ দিলেন‚ নরলোকে শিব পূজিত হবেন লিঙ্গ রূপে | পার্বতীর যোনিতে প্রোথিত শিবলিঙ্গ রূপে |
সবার শেষে ভৃগুর গন্তব্য বিষ্ণুলোক | গিয়ে দেখেন বিষ্ণু নিদ্রামগ্ন | কুপিত ভৃগু তাঁর বুকে পদচালনা করলেন | যে চিহ্ন অঙ্কিত হল‚ তাকে বলে শ্রীবৎস | নিদ্রা ভঙ্গ করে উঠলেন নারায়ণ | ভৃগুর উপর ক্রোধ প্রদর্শন না করে স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন‚ ‘ হে মহর্ষি‚ আমার কঠিন বুকে আপনার কোমল চরণ যে পড়ল তাতে সেটি আহত হয়নি তো ?’
নারায়ণের এই আচরণে ভৃগু স্থির করলেন ত্রিদেবের মধ্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ | যদিও ভৃগুর এই আচরণে রেগে গেলেন বিষ্ণুপত্নী মহালক্ষ্মী | তিনি শাপ দিলেন ব্রাহ্মণরা কোনওদিন লক্ষ্মীর কৃপা পাবেন না | শেষে ভৃগু তাঁর আগমনের কারণ বললেন | তখন লক্ষ্মী ক্ষোভ প্রশমিত করে জানালেন‚ বিষ্ণুর উপাসনা করলে ব্রাহ্মণরা লক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন না |
যাই হোক‚ যজ্ঞস্থলে ঋষিদের কাছে ফিরে এসে ভৃগু নিজের অভিজ্ঞতা বললেন | কিন্তু ঋষিরা তাঁর এই উদ্ধত আচরণ ভালভাবে নিলেন না | ভৃগু ক্ষমা চাইলেন দেবতাদের কাছে | এটাই স্থির হল‚ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিন দেবতাই সমগুরুত্বপূর্ণ |
এ বার একটা তথ্য জানিয়ে রাখি‚ ভৃগু কিন্তু একবার কুপিত হয়ে নারায়ণকেও অভিশাপ দিয়েছিলেন | বিষ্ণু বা নারায়ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে ভৃগুপত্নীর মস্তকচ্ছেদ করেছিলেন | কারণ ঋষিপত্নী দেবতা-অসুরদের যুদ্ধে অসুরদের সাহায্য করেছিলেন | যদিও স্ত্রীর প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন ভৃগু‚ তা সত্ত্বেও ক্রোধান্বিত এই ঋষি অভিশাপ দেন‚ বিষ্ণুকে বারবার নরলোকে জন্ম নিয়ে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে | সেই থেকেই নাকি বিষ্ণু দশ অবতারে জন্ম নেন পৃথিবীতে |
এতদূর পড়ে মনে হতে পারে এই প্রতাপান্বিত ঋষি শুধু দেবতাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে গিয়ে তাঁদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন | কিন্তু এটা স্মর্তব্য যে মহর্ষি ভৃগু রচনা করেছেন জ্যোতিষ-সহ অন্যান্য শাস্ত্রের প্রামাণ্য আকর গ্রন্থ ভৃগুসংহিতা | আজও ভারতের নানা জায়গায় আছে তাঁর আশ্রম |
No comments:
Post a Comment